হার্ভার্ডকে কেন ‘আমেরিকান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’ বলা হয় না? বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিশ্ব ইতিহাস আপনার ধারণার চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর
আপনি কি কখনো একটি প্রশ্ন ভেবে দেখেছেন?
আমাদের চারপাশে ‘জাতীয়’ সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ‘জাতীয়’ তাইওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় আছে, এমনকি রাশিয়ারও অনেক ‘জাতীয়’ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। কিন্তু বিশ্বের সেরা শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান যেমন হার্ভার্ড, ইয়েল, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ—এদের নামের মধ্যে ‘জাতীয়’ (National) শব্দটি কেন নেই?
আরও অদ্ভুত বিষয় হলো, ব্রিটেনে ‘ইম্পেরিয়াল কলেজ’ (Imperial College) নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যা শুনতে বেশ প্রভাবশালী; অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ও জাপান মরিয়া হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থেকে ‘ইম্পেরিয়াল’ বা ‘জাতীয়’ শব্দগুলো মুছে ফেলেছে।
এর পেছনে আসলে কী রহস্য? ‘জাতীয়’ শব্দটির কি বিদেশে এমন কোনো অর্থ আছে যা আমরা জানি না?
আজ, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই গোপন রহস্য উন্মোচন করব। আসলে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা অনেকটা একটি রেস্তোরাঁর নামকরণের মতোই—নামটি কেবল একটি পরিচয় নয়, এটি একটি ঘোষণা।
প্রথম ধরনের রেস্তোরাঁ: "লাও ওয়াং-এর ঘরোয়া রান্না" — স্থানীয় সম্প্রদায়কে সেবা প্রদানকারী আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়
কল্পনা করুন, আপনি আমেরিকায় একটি রেস্তোরাঁ খুলতে চান, আপনি কি সেটির নাম দেবেন "আমেরিকার প্রথম মাস্টার শেফ"? সম্ভবত দেবেন না। আপনি হয়তো সেটির নাম দেবেন "ক্যালিফোর্নিয়া সানশাইন কিচেন" অথবা "টেক্সাস বারবিকিউ হাউস"। এটি শুনতে বন্ধুত্বপূর্ণ ও খাঁটি, এবং এটি স্পষ্ট করে সবাইকে বলে: আমি এই এলাকার বাসিন্দাদের সেবা দিচ্ছি।
আমেরিকার "প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়" (State University) এই একই যুক্তি অনুসরণ করে।
যেমন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (University of California), টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় (University of Texas)—এদের নামের মধ্যে ‘রাষ্ট্র’র (State) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, ‘জাতি’র (Nation) ওপর নয়। এটি একটি অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত পদ্ধতি, যা একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসাধারণের সেবামূলক বৈশিষ্ট্যকে প্রতিফলিত করে, যা তাদের রাজ্যের করদাতাদের জন্য নিবেদিত, তেমনি ‘ন্যাশনাল’ শব্দটি থেকে সম্ভাব্য জটিলতাও কৌশলে এড়িয়ে যায়।
কারণ আমেরিকা এবং অনেক পশ্চিমা দেশে, ‘জাতীয়তাবাদ’ (Nationalism) একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল শব্দ, যা সহজেই যুদ্ধ, সংঘাত এবং বিদেশী বিদ্বেষের জন্ম দিতে পারে। তাই, ‘ন্যাশনাল’ এর পরিবর্তে ‘স্টেট’ ব্যবহার করা অনেকটা একটি রেস্তোরাঁর নাম "লাও ওয়াং-এর ঘরোয়া রান্না" রাখার মতো—নীরব, বাস্তবসম্মত, এবং প্রতিবেশীদের জন্য সেরা সেবা প্রদানে মনোযোগী।
দ্বিতীয় ধরনের রেস্তোরাঁ: "চায়নার ফার্স্ট টাওয়ার" — জাতীয় ভাবমূর্তি বহনকারী শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়
অবশ্য, এমন রেস্তোরাঁ মালিকও আছেন যারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং দেশের জন্য একটি মানদণ্ড স্থাপন করতে চান। তিনি তার রেস্তোরাঁর নাম দেবেন "চায়নার ফার্স্ট টাওয়ার" বা "বেইজিং রোস্ট ডাক হেডকোয়ার্টার"। এই নামটি প্রকাশ পাওয়ামাত্রই এটি এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী আত্মবিশ্বাসকে তুলে ধরে; এটি শুধু একটি রেস্তোরাঁ নয়, বরং জাতীয় রন্ধনপ্রণালীর প্রতিচ্ছবি।
কিছু দেশের ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ এই ভূমিকা পালন করে।
যেমন ‘অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’ (Australian National University) বা ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর’ (National University of Singapore)। এই দেশগুলোতে, ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’ সাধারণত একটিই থাকে, যা সারাদেশের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় নির্মিত একটি শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পুরো দেশের সর্বোচ্চ মানকে উপস্থাপন করে। এর নামটি হলো একটি উজ্জ্বল জাতীয় পরিচিতি কার্ড।
এটি আমাদের পরিচিত, যেখানে অনেক ‘জাতীয়’ বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের কাছে, ‘ন্যাশনাল’ মানে এক অনন্য এবং সম্মানজনক মর্যাদা।
তৃতীয় ধরনের রেস্তোরাঁ: "ইয়ামাতো বিজয়ী ক্যান্টিন" — আগ্রাসনের ছাপ বহনকারী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববিদ্যালয়
এবার, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিটি কল্পনা করুন।
একটি রেস্তোরাঁ, যার নাম ঘরোয়া রান্না নয়, প্রথম টাওয়ারও নয়, বরং "ইয়ামাতো বিজয়ী ক্যান্টিন" অথবা "জার্মান শ্রেষ্ঠ ভোজ", এবং এটি দখলকৃত ভূমিতে খোলা হয়েছে। এই রেস্তোরাঁর উদ্দেশ্য রান্না করা নয়, বরং এর নাম ও অস্তিত্ব দিয়ে স্থানীয়দেরকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেওয়া: "তোমরা আমাদের দ্বারা পরাজিত হয়েছো।"
এ কারণেই ‘ন্যাশনাল’ এবং ‘ইম্পেরিয়াল’ (সাম্রাজ্যবাদী) এই দুটি শব্দ ইতিহাসে এতটাই ‘বিষাক্ত’ হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, নাৎসি জার্মানি এবং জাপানি সাম্রাজ্য দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে তথাকথিত "সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ববিদ্যালয়" (Reichsuniversität / 帝国大学) প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই স্কুলগুলো ছিল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং জাতিগত আত্তীকরণ প্রচারের হাতিয়ার, এবং তাদের নাম ছিল মুখে খোদাই করা ঐতিহাসিক ট্যাটুর মতো, যা সহিংসতা ও নিপীড়নে পূর্ণ ছিল।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, এই নামগুলো চরম অবমাননার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জার্মানি, জাপান এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো দ্রুত এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলে। সবাই ‘ন্যাশনাল’ শব্দটি নিয়ে অত্যন্ত সতর্ক হয়ে ওঠে, পাছে এটি ফ্যাসিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
এ কারণেই আজ ইউরোপ মহাদেশে আপনি ‘ন্যাশনাল’ নামে নামকরণ করা বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া কঠিন। এমনকি নেদারল্যান্ডসের দীর্ঘদিনের ঐতিহাসিক ‘রাইকসুনিনিভার্সিটি’ (Rijksuniversiteit) (আক্ষরিক অর্থে যার অর্থ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি), যখন বাইরের জগতে নিজেদের প্রচার করে, তখন তারা কৌশলে এটিকে আরও নিরপেক্ষ ‘স্টেট ইউনিভার্সিটি’ হিসেবে অনুবাদ করতে পছন্দ করে, যাতে কোনো অপ্রয়োজনীয় সংযুক্তি এড়ানো যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের আড়ালে বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি
এখন, আমরা যখন আবার সেই নামগুলোর দিকে তাকাই, তখন সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যায়:
- আমেরিকা ‘প্রাদেশিক’ শব্দ ব্যবহার করে, যা প্রয়োগবাদিতার নিদর্শন, এবং এটি স্থানীয় সেবার ওপর জোর দেয়।
- ব্রিটেন ‘ইম্পেরিয়াল কলেজ’ ধরে রেখেছে, যা যেন ‘সূর্য অস্তমিত না হওয়া সাম্রাজ্যের’ গৌরব ভুলে না যাওয়া কোনো পুরনো অভিজাতের মতো; ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত হয়েছে।
- অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর ‘জাতীয়’ শব্দ ব্যবহার করে, যা একটি জাতীয় পরিচিতি কার্ড, এবং এটি উচ্চ পর্যায়ের আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করে।
- ইউরোপ মহাদেশ সাধারণত ‘জাতীয়’ শব্দ এড়িয়ে চলে, যা ইতিহাসের প্রতি তাদের আত্ম-প্রতিফলন, এবং অসহনীয় অতীত থেকে সতর্কতার সাথে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে।
একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের আড়ালে একটি দেশের বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধ লুকিয়ে থাকে। এটি আমাদের বলে যে, ভাষা কেবল আক্ষরিক অর্থের সমষ্টির চেয়ে অনেক বেশি কিছু। প্রতিটি শব্দের পেছনে সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং অনুভূতি নিহিত থাকে।
এটিই সেই স্থান যেখানে আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। সাধারণ যন্ত্র অনুবাদ হয়তো আপনাকে বলতে পারে ‘ন্যাশনাল’ মানে ‘জাতীয়’, কিন্তু এটি আপনাকে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এর হাজার হাজার অর্থ বলতে পারে না—এটি কি গৌরব, দায়িত্ব, নাকি একটি ক্ষত?
সত্যিকার অর্থে বিশ্বকে বুঝতে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পটভূমির মানুষের সাথে গভীর কথোপকথন করতে, আমাদের এই শব্দগুলোর পেছনের গল্পগুলো দেখতে হবে।
এবং এটিই, যোগাযোগের প্রকৃত অর্থ।
আপনি কি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সাথে গভীর আলোচনা করতে এবং তাদের ভাষার পেছনের সাংস্কৃতিক গল্পগুলো বুঝতে চান? Intent ব্যবহার করে দেখুন। এটি একটি চ্যাটিং অ্যাপ্লিকেশন, যেখানে অত্যাধুনিক এআই অনুবাদ ব্যবস্থা অন্তর্নির্মিত আছে, যা আপনাকে ভাষার বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করবে এবং বিশ্বের যে কারোর সাথে অবাধে কথা বলতে এবং পরস্পরকে সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।